কোরআন পড়ুন আর দু আ করুন
সূরা ফাতেহা আল্লাহ্ ও বান্দার কথোপকথন
কুরআনের যে সুরা দোয়া ও শেফা
কুরআনুল কারিম। যার প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ও বাক্য ফজিলত ও বরকতে ভরপুর। এ আসমানি কিতাবের প্রথম সুরা এমনি এক ফজিলত ও বরকতময় সুরা। যা প্রতিটি মানুষের জন্য গুরত্বপূর্ণ দোয়া ও রোগ থেকে মুক্তির শেফা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত লাভের একেবারেই প্রথম দিকে পুরো সুরাটি একসঙ্গে নাজিল হয়। যে সুরা পড়া ছাড়া মুমিনের নামাজ হয় না। এ সুরাটি পবিত্র কুরআনের ভূমিকাও বটে।
মুমিন মুসলমানের জন্য এ সুরাটি হচ্ছে দোয়া। যে কোনো ব্যক্তিই কুরআন পড়া শুরু করলে আল্লাহ তাআলা তাকে প্রথমেই এ দোয়াটিই শিখিয়ে দেন। আর এ কারণে সুরাটিকে কুরআনুল কারিমের প্রথম সুরা হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে।
মানুষের যে জিনিসের আকাঙ্খা সবচেয়ে বেশি থাকে, সে জিনিস লাভের প্রার্থনাই বেশি করে থাকে। দুনিয়াতে মানুষের সবচেয়ে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাহলো হেদায়েত ও সঠিক পথ পাওয়া। আর তা পেতে হলে প্রয়োজন কুরআন অনুযায়ী জীবন গড়া। কুরআনের নেয়ামত লাভের দোয়াই হলো এ সুরা।
বুঝার সুবিধার্থে সুরাটির অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
- সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি পুরো বিশ্বজগতের অধিপতি।
- তিনি পরম দয়ালু ও করুনাময়।
- তিনি প্রতিদান দিবসের মালিক।
- আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য চাই।
- তুমি আমাদের সোজা (হেদায়েতের) পথ দেখাও।
- তাদের পথ, যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ।
- তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট।' (সুরা ফা���েহা)
সুরা ফাতেহায় শেফা
মানবজাতির জন্য কুরআন যেমন শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ তেমনি শ্রেষ্ঠ সুরাও এটি। যদি কেউ এ সুরার আমল ও অধ্যয়ন যথাযথভাবে মেনে চলে তবে তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব সমস্যার সমাধানেও রয়েছে তাতে। সুরা ফাতেহা সব রোগের মহৌষধ। এটি মানুষের রোগ-ব্যধিতে অনেক বড় শেফা-
- হজরত জাফর সাদেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সুরা ফাতেহা ৪০ বার পাঠ করে পানির ওপর দম করে কোনো জ্বরে আক্রন্ত লোকের মুখমণ্ডলে ছিঁটিয়ে দিলে, এর বরকতে জ্বর দূরীভূত হয়ে যাবে।
- ফজরের নামাজের সুন্নত ও ফরজ নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে ৪১ বার এ সুরা পাঠ করে চোখে ফুঁ দিলে চোখের ব্যথা দূর হয়।
- শেষ রাতে এ সুরা ৪১ বার তেলাওয়াত করলে আল্লাহ তাআলা রিজিক বাড়িয়ে দেন।
- এ সুরা ৪০ দিন নিয়মিত তেলাওয়াত করে পানিতে ফুঁ দিয়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে পান করালে আল্লাহ অসুস্থতা দূর করে দেবেন।
- দাঁত, পেট ও মাথা ব্যথার জন্যে সুরাটি ৭ বার তেলওয়াত করে ফুঁ দিলে আল্লাহ এ ব্যাথ্যা থেকে মুক্তি দেন।
- হজরত ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সাহাবাদের একটি দল এক পানির কুপওয়ালার কাছে গেলেন। তাদের (কুপওয়ালাদের) একজনকে বিচ্ছু অথবা সাপে দংশন করেছিল।
কুপওয়ালাদের এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনাদের মধ্যে কোনো মন্ত্র জানা লোক আছে কি? এ পানির ধারে বিচ্ছু বা সাপে দংশন করা একজন লোক আছে।
সাহাবাদের মধ্যে একজন (আবু সাঈদ খুদরি) গেলেন এবং কয়েকটি ভেড়ার বিনিময়ে তার উপর সুরা ফাতেহা পড়ে ফুঁ (দম করলেন) দিলেন। এতে সে ভাল হয়ে গেল এবং তিনি ভেড়াগুলো নিয়ে সঙ্গীদের কাছে আসলেন।
তারা (সাহাবারা) এটা অপছন্দ করল এবং বলতে লাগল, আপনি কি আল্লাহর কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করলেন?
অবশেষে তারা মদিনায় পৌঁছে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি আল্লাহর কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করেছেন।
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা যেসব জিনিসের বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তার মধ্যে আল্লাহর কিতাব অধিকতর উপযোগী’। (বুখারি)
- অন্য বর্ণনায় আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা ঠিক করেছ। ছাগলের একটি ভাগ আমার জন্য রাখ।' (বুখারি ও মুসলিম)
কুরআনের শ্রেষ্ঠ দোয়া
সুরাটি কুরআনের ভূমিকাই নয় বরং এটি শ্রেষ্ঠ দোয়াও বটে। এ সুরা তেলাওয়াত করা ছাড়া নফল, ওয়াজিব কিংবা ফরজ ছাড়া কোনো নামাজই হবে না। শ্রেষ্ঠ দোয়া সুরা ফাতিহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নামাজ ফরজ ওয়াজিব সুন্নাত নফল যা-ই হোক না কেন, সুরা ফাতিহা ছাড়া কোনো নামাজই হবে না। এ দোয়ার বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় হাদিসে এসেছে-
- ‘আল্লাহ তাআলা এ সুরায় নিজের ও বান্দার মধ্যে করণীয় ভাগ করে নিয়েছেন। এ সুরাকে বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব নয়।’ (সুরা হিজর, কুরতুবি, বুখারি, মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, মুসলিম, মিশকাত)
- হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ উম্মুল কুরআনের মতো তাওরাত ও ইঞ্জিলে কিছু্ নাজিল করেননি। এটিকেই বলা হয়, ‘আস-সাবউল মাছানি’ (যা বারবার পঠিত সাতটি আয়াত), যাকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। আর আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, সে যা চাইবে’। (নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ)
- হজরত সাঈদ ইবনে মুআল্লা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তিনি মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ডাকলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দেননি। অতপর নামাজ শেষ হলে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি নামাজ পড়ছিলাম।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ কি বলেননি? ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ডাকে সাড়া দাও, যখন তোমাদেরকে ডাকা হয়।’ (সুরা আনফাল : আয়াত ২৪)
অতপর আমাকে বললেন, মসজিদ থেকে তোমার বের হওয়ার আগেই আমি তোমাকে অবশ্যই কুরআনের সবচেয়ে মহান সুরাটি শিক্ষা দেব। অতপর তিনি আমার হাত ধরলেন। যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হতে চাইলেন, তখন আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, আপনি কি আমাকে বলেননি যে, তোমাকে আমি কুরআনের সবচেয়ে মহান সুরাটি শিখিয়ে দেব?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সুরাটি হচ্ছে- الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ । এটিই সাবউল মাছানি এবং কুরআনুল আজিম। যা আমাকে দেয়া হয়েছে।' (নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
- হজরত ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিবরিল আলাইহিস সালাম উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ জিবরিল আলাইহিস সালাম ওপর দিকে এক শব্দ শুনতে পেলেন এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ হচ্ছে আকাশের একটি দরজা যা আগে কখনো খোলা হয়নি।
সে দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হলেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘আপনি দুটি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। যা আপনাকে প্রদান করা হয়েছে। তা আপনার আগে আর কোনো নবিকে দেয়া হয়নি। তাহলো-
- সুরা ফাতেহা এবং
- সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত।
আপনি সে দু’টি থেকে কোনো অক্ষর পড়লেই তার প্রতিদান আপনাকে প্রদান করা হবে।’ (মুসলিম, ইবনে হিব্বান)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুরা ফাতিহার তেলাওয়াত ও আমলের মাধ্যমে অসুস্থতা ও সমস্যা থেকে মুক্তির পাশাপাশি সুরাটি যাবতীয় ফজিলত ও বরকত লাভ করার তাওফিক দান করুন। সুরার হক অনুযায়ী ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
https://www.youtube.com/watch?v=xhCsGi5QFCU
0 notes
সূরা আল ফাতিহা
সমগ্র কোরআনের সার-সংক্ষেপ
সূরা আল ফাতিহা (আরবি: سورة الفاتحة) মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনের প্রথম সূরা।
আরবি থেকে বাংলা অনুবাদ ও অর্থ-
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহির রহমা-নির রহি-ম।
অনুবাদ : শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
উচ্চারণ : আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আ -লামি-ন।
অনুবাদ : যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
উচ্চারণ : আররহমা-নির রাহি-ম।
অনুবাদ : যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু।
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
উচ্চারণ : মা-লিকি ইয়াওমিদ্দি-ন।
অনুবাদ : বিচার দিনের একমাত্র অধিপতি।
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
উচ্চারণ : ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কা নাসতাই’-ন
অনুবাদ : আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
উচ্চারণ : ইহদিনাস সিরাতা’ল মুসতাকি’-ম
অনুবাদ : আমাদের সরল পথ দেখাও।
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
উচ্চারণ : সিরাতা’ল্লা যি-না আনআ’মতা আ’লাইহিম গা’ইরিল মাগ’দু’বি আ’লাইহিম ওয়ালা দ্দ-ল্লি-ন।
অনুবাদ : সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
এর শ্রেণী: মক্কী সূরা।
নামের অর্থ: শুরু।
অন্য নাম: উম্মুল কিতাব, চাবি, উম্মুল কোরআন, সূরা আল হামদ।
অবতীর্ণ হওয়ার সময়: নবী মোহাম্মদ-এর নবুয়্যত প্রাপ্তির শুরুর দিকে।
পরিসংখ্যান-
সূরার ক্রম: ১
আয়াতের সংখ্যা: ৭
পারার ক্রম: ১
রুকুর সংখ্যা: ১
বিশেষ বিষয় সম্পর্কে আয়াতের সংখ্যা-
আল্লাহর প্রশংসা: ৩
স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক: ১
মানবজাতির প্রার্থনা: ৩
পরবর্তী সূরা: সূরা আল-বাকারা
ফাতিহা শব্দটি আরবি ‘ফাতহুন’ শব্দজাত যার অর্থ ‘উন্মুক্তকরণ’। এটি আল্লহ`র তরফ থেকে বিশেষ উপহার। সূরা ফাতিহা অন্যান্য সূরার ন্যায় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দিয়ে শুরু। আল ফাতিহা সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে বিধায় মক্কী সূরা হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ।
নামকরণ:
এ সূরার বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এর এই নামকরণ করা হয়েছে। যার সাহায্যে কোনো বিষয়, গ্রন্থ বা জিনিসের উদ্বোধন করা হয় তাকে ‘ফাতিহা’ বলা হয়। অন্য কথায় বলা যায়, এ শব্দটি ভূমিকা এবং বক্তব্য শুরু করার অর্থ প্রকাশ করে।
নাজিল হওয়ার সময়-কাল:
এ সূরাটি প্রিয়নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের একেবারেই প্রথম যুগের সূরা। এটি মুহম্মদ (সা.) এর ওপর নাজিলকৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা। এর আগে মাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু আয়াত নাজিল হয়েছিল। সেগুলো সূরা ‘আলাক্ব’, ‘মুয্যাম্মিল’ ও ‘মুদ্দাস্সির’ ইত্যাদিতে সন্নিবেশিত হয়েছে:
বিষয়বস্তু:
আসলে এ সূরাটি হচ্ছে একটি দোয়া। যেকোনো ব্যক্তি এ গ্রন্থটি পড়তে শুরু করলে আল্লাহ প্রথমে তাকে এ দোয়াটি শিখিয়ে দেন। গ্রন্থের শুরুতে এর স্থান দেয়ার অর্থই হচ্ছে এই যে, যদি যথার্থই এ গ্রন্থ থেকে তুমি ল��ভবান হতে চাও, তাহলে নিখিল বিশ্ব-জাহানের মালিক মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহর কাছে দোয়া এবং সাহায্য প্রার্থনা করো।
মানুষের মনে যে বস্তুটির আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা থাকে স্বভাবত মানুষ সেটিই চায় এবং সে জন্য দোয়া করে। আবার এমন অবস্থায় সে এই দোয়া করে যখন অনুভব করে যে, যে সত্তার কাছে সে দোয়া করছে তার আকাংখিত বস্তুটি তারই কাছে আছে। কাজেই পবিত্র কোরআনের শুরুতে এই দোয়ার শিক্ষা দিয়ে যেন মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সত্য পথের সন্ধান লাভের জন্য এ গ্রন্থটি পড়, সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে এর পাতা ওলটাও এবং নিখিল বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভু মহান আল্লাহ হচ্ছেন জ্ঞানের একমাত্র উৎস। একথা জেনে নিয়ে একমাত্র তাঁর কাছেই পথনির্দেশনার আর্জি পেশ করেই এ গ্রন্থটি পাঠের সূচনা কর।
এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, পবিত্র কোরআন ও সূরা ফাতিহার মধ্যকার আসল সম্পর্ক কোন বই ও তার ভূমিকার সম্পর্কের পর্যায়ভুক্ত নয়। বরং এ মধ্যকার আসল সম্পর্কটি দোয়া ও দোয়ার জবাবের পর্যায়ভুক্ত।
সূরা ফাতিহা বান্দার পক্ষ থেকে একটি দোয়া। আর পবিত্র কোরআন তার জবাব আল্লাহর পক্ষ থেকে। বান্দা দোয়া করে, হে মহান প্রভু! আমাকে পথ দেখাও। জবাবে মহান প্রভু এই বলে সমগ্র পবিত্র কোরআন তার সামনে রেখে দেন: এই নাও সেই হিদায়াত ও পথের দিশা যে জন্য তুমি আমার কাছে আবেদন জানিয়েছ।
বৈশিষ্ট্য:
এই সূরাটি পবিত্র কোরআনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূরা। প্রথমত: এ সূরা দ্বারাই পবিত্র কোরাআন আরম্ভ হয়েছে এবং এ সূরা দিয়েই সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদত সালাত আরম্ভ হয়। অবতরণের দিক দিয়েও পূর্ণাঙ্গ সূরারুপে এটিই প্রথম নাজিল হয়। সূরা `ইকরা`, `আল-মুজাম্মিল` ও `আল-মুদ্দাসসির` এর ক`টি আয়াত অবশ্য সূরা আল-ফাতিহার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এ সূরার অবতরণই সর্বপ্রথম।
যে সকল সাহাবী (রা.) সূরা আল-ফাতিহা সর্বপ্রথম নাজিল হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের সে বক্তব্যের অর্থ বোধহয় এই যে, পরিপূর্ণ সূরারূপে এর আগে আর কোনো সূরা নাজিল হয়নি। এ জন্যই এ সূরার নাম `ফাতিহাতুল-কিতাব` বা কোরআনের উপক্রমণিকা রাখা হয়েছে।
`সূরা আল ফাতিহা` এদিক দিয়ে সমগ্র কোরআনের সার-সংক্ষেপ। এ সূরায় সমগ্র কোরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্ত আকারে বলে দেয়া হয়েছে। কোরআনের অবশিষ্ট সূরাগুলো প্রকারান্তরে সূরা ফাতিহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। তাই এ সূরাকে সহীহ হাদীসে `উম্মুল কিতাব`, `উম্মুল কোরআন`, `কোরানে আযীম` বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
মুহম্মদ (সা.) এরশাদ করেছেন যে, ‘যার হাতে আমার জীবন-মরণ, আমি তাঁর শপথ করে বলছি, সূরা আল-ফাতিহার দৃষ্টান্ত তাওরাত, ইনজীল, যাবুর প্রভৃতি অন্য আসমানী কিতাবে তো নেই-ই, এমনকি পবিত্র কোরআনেও এর দ্বিতীয় নেই।
ইমাম তিরমিযী আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলে কারীম (সা.) আরো বলেছেন যে, সূরায়ে ফাতিহা প্রত্যেক রোগের ওষুধবিশেষ।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা:
সূরা আল-ফাতিহার প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এ সূরার প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা ও তারীফের বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর তফসীরে একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তারীফ ও প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে ঈমানের মৌলিক নীতি ও আল্লাহর একত্ববাদের বর্ণনাও সূক্ষভাবে দেয়া হয়েছে। তৃতীয় আয়াতে এর দু`টি শব্দে তারীফ ও প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের বিপ্লবাত্মক মহোত্তম আকীদা যথা কিয়ামত ও পরকালের বর্ণনা প্রমাণসহ উপস্থিত করা হয়েছে।
চতুর্থ আয়াতের এক অংশে তারীফ ও প্রশংসা এবং অপর অংশে দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়েছে। মানবজীবন তিনটি অবস্থায় অতিবাহিত হয়- অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। পূর্বের তিনটি আয়াতের মধ্যে الْحَمْدُ للّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ এবং الرَّحْمـنِ الرَّحِيمِ - এ দু`টি আয়াতে মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, অতীতে সে কেবল মাত্র আল্লাহর মুখাপেক্ষী ছিল, বর্তমানেও সে একমাত্র তারই মুখাপেক্ষী। অস্তিত্বহীন এক অবস্থা থেকে তিনি তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। পরবর্তী আয়াতে مَـالِكِ يَوْمِ الدِّينِ - এর মধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতেও সে আল্লাহর মুখাপেক্ষী। প্রতিদান দিবসে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য পাওয়া যাবে না।
একজন বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তি মনের গভীরতা থেকেই এ স্বতঃস্ফুর্ত স্বীকৃতি উচ্চারণ করছে যে, আমরা তোমাকে ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করি না। এ মৌলিক চাহিদাই إِيَّاكَ نَعْبُدُ-তে বর্ণনা করা হয়েছে। অভাব পূরণকারী একক সত্তা আল্লাহ, সুতরাং নিজের যাবতীয় কাজে সাহায্যও তার নিকট প্রার্থনা করবে। এ মৌলিক চাহিদাই বর্ণনা وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ -এ করা হয়েছে। মোটকথা, এ চতুর্থ আয়াতে একদিকে আল্লাহর তারীফ ও প্রশংসার সঙ্গে একথারও স্বীকৃতি রয়েছে যে, ইবাদত ও শ্রদ্ধা পাওয়ার একমাত্র তিনিই যোগ্য।
অপরদিকে তার নিকট সাহায্য ও সহায়তার প্রার্থনা করা এবং তৃতীয়ত: আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করার শিক্ষাও দেয়া হয়েছে। শেষ তিনটি আয়াতে মানুষের দোয়া ও আবেদনের বিষয়বস্তু এবং এক বিশেষ প্রার্থনা পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে-
اهدِنَــــا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنعَمتَ عَلَيهِمْ غَيرِ المَغضُوبِ عَلَيهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ
‘আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাজিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।’
এই তিনটি আয়াতে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন, সরল পথের হেদায়াতের জন্য যে আবেদন এ আয়াতে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, এর আবেদনকারী যেমনিভাবে সাধারণ মানুষ, সাধারণ মুমিনগণ, তেমনি আওলিয়া, গাউস-কুতুব এবং নবী-রাসূলগণও বটে।
পবিত্র কোরআনের শিক্ষায় স্পষ্টতঃই এ তথ্য ব্যক্ত হয়েছে যে, সৃষ্টির প্রতিটি স্তর, এমনকি প্রতিটি অণু-পরমাণু পর্যন্ত নিজ নিজ অবস্থানু্যায়ী প্রাণ ও অনুভূতির অধিকারী। স্ব-স্ব পরিমন্ডলে প্রতিটি বস্তুর বুদ্ধি-বিবেচনা রয়েছে। অবশ্য এ বুদ্ধি ও অনুভূতির তারতম্য রয়েছে। কোনটাতে তা স্পষ্ট এবং কোনটাতে নিতান্তই অনুল্লেখ্য। বুদ্ধি ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এ তারতম্যের জন্যই সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জিন জাতিকেই শরীয়তের হুকুম-আহকামের আওতাভুক্ত।
কারণ, সৃষ্টির এ দু`টি স্তরের মধ্যেই বুদ্ধি ও অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, একমাত্র মানুষ ও জিন জাতি ছাড়া সৃষ্টির অন্য কোনো কিছুর মধ্যে বুদ্ধি ও অনুভূতির অস্তিত্ব নেই। কেননা, আল্লাহ্ সূরা বনী-ইসরাঈলে এরশাদ করেছেন,
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلاَّ يُسَبِّحُ بِحَمْدَهِ وَلَـكِن لاَّ تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا
‘সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যাকিছু আছে সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এবং এমন কিছু নেই যা তার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা, মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয় তিনি অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।’ (সূরা: বনী-ইসরাঈল, আয়াত: ৪৪)
মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আন নূরে এরশাদ করেছেন,
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَافَّاتٍ كُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهُ وَتَسْبِيحَهُ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ
‘তুমি কি দেখ না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা এবং উড়ন্ত পক্ষীকুল তাদের পাখা বিস্তার করতঃ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য এবাদত এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পদ্ধতি জানে। তারা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’ (সূরা: আন নূর, আয়াত: ৪১)
তথ্যসূত্র: ‘আল ফাতিহাহ’। কুরতুবী, মারেফুল কোরআন, উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ।
https://www.youtube.com/watch?v=sIbBnCTvja8
0 notes